দেশের ১৮ দশমিক ৪ ভাগ পূর্ণবয়স্ক মানুষ যা মোট জনসংখ্যার অনুপাতে প্রায় তিন কোটি, সেই মানুষগুলো এখন মানসিক সমস্যায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক।
মন্ত্রী বলেন, এর বাইরে আরো ১৩ ভাগ শিশু কিশোরও এই মানসিক রোগে আক্রান্ত। দেশে বর্তমানে বছরে ১০ থেকে ১৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করছে, যা ভাববার মতো একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে চিকিৎসা সেবা বৃদ্ধি করা জরুরি।
বুধবার দুপুরে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য রিপোর্ট ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কর্মকৌশল পরিকল্পনা ২০২০-৩০ এর অবহিতকরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, অন্যান্য জটিল রোগগুলোর মতই মানসিক স্বাস্থ্যকে আর হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই।”
জাহিদ মালেক এ সময় বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে দক্ষ জনবল বাড়ানোর বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে। বিভিন্ন সমস্যার কারণে অনেকে চাকরি হারায়, দেশের প্রোডাক্টিভিটি কমে যায়, অপরাধের মাত্রা বাড়ে এমনকি উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বাড়ে এই মানসিক স্বাস্থ্যের কারণে। অন্যদিকে দেখা গেছে, মানসিক স্বাস্থ্যে বাজেট মাত্র দশমিক পাঁচ শতাংশ যা অনেক কম। এটি কিভাবে বাড়ানো যায় তা চেষ্টা করা হবে। আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শতকরা ৯২ ভাগ মানুষ মানসিক চিকিৎসা সেবার বাইরে রয়েছে। এটি নিয়েও আমাদেরকে আরো বেশি কাজ করতে হবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা জানি মানসিক সমস্যায় বিশ্বে বহু লোকের প্রাণহানি ঘটে। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশে বছরে ১০-১৪ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে মানসিক রোগে।
বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে সরকার নানামুখী ব্যবস্থা নিয়েছে। পাবনা মানসিক হাসপাতালকে ২০০ বেড থেকে ৪০০ বেডে উন্নীত করা সহ আরও নানাবিধ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় কাউন্সিলিং করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রায় ২০০ উপজেলায় থাকা এনসিডি কর্নার রয়েছে, সেখানেও এই কাউন্সিলিং করার ব্যবস্থা থাকছে। তবে অনেককিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। শুধু যে সুযোগ-সুবিধার কারণে সমস্যা হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। সচেতনতায়ও এখনো নানা গ্যাপ রয়েছে।
এ সময় জাহিদ মালেক বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে পরিবার থেকেই পরিবর্তন আনার ওপর গুরুত্ত্বারোপ করেন সুচনা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, অনুষ্ঠানের কী-নোট বক্তা, প্রধানমন্ত্রী কন্যা সায়মা ওয়াজেদ। তিনি বলেন, একজন মানুষের মানবিকতা দিয়ে আরেকজন মানুষের মানসিক কষ্টের কথা বিবেচনা করলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবাহীন মানুষগুলো আরেকটু ভালো সেবা পাবেন। দেশে এখন মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে প্রয়োজনীয় সবরকম আইন করা হয়েছে। কর্ম পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এখন সেগুলো কাজে প্রয়োগ করতে হবে।
সায়মা ওয়াজেদ বলেন, আমাদের শারীরিক চিকিৎসা নানা কর্মকৌশল থাকলেও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ছিল না। এ জন্য নানা পরিকল্পনা আমরা করেছি। মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য একটা উন্নত পরিবেশ দরকার। শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চাইলেই হবে না, আমাদের সবার এগিয়ে আসতে হবে। পরিবার থেকেই এটি চালু করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী কন্যা বলেন, আজ গর্ব করে বলতে হয় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বাংলাদেশের একটি কর্মকৌশল আছে, একটি আইন আছে। কিন্তু সবাই এগিয়ে না আসলে, কাজ না করলে এগোবেনা। সবার আগে নিজেদের পরিবর্তন করতে হবে। জাতি হিসেবে আমরা অনেক কিছু হারিয়েছে। সেখান থেকে উন্নত দেশের কাতারে এসেছি, তাহলে কেন আমরা মানসিক স্বাস্থ্যের মত জায়গায় এগোতে পারব না?
এ সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে উন্নতি করতে চাইলে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এই খাতে মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বরাদ্দের ৬০ ভাগই খরচ হচ্ছে ট্রেনিংসহ অন্যান্য কাজে। তাই বরাদ্দ বাড়ানো খুবই জরুরি।
তিনি বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যে যে ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়, সেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যে ইস্কিন সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে হবে। সেবার ব্যবস্থাপনা, মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি, ই মেন্টাল হেলথ ও গবেষণাসহ প্রত্যকেটিরই কিছু না কিছু কাজ হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানের একটি ইনস্টিটিউট তৈরির পরিকল্পনা আমাদের আছে। পোস্ট গ্রাজুয়েটের ট্রেনিং দেওয়া হবে সেখানে। ২০২০ সালের পরিকল্পনা অনুযায়ী অপারেশন প্লান তৈরি হয়েছে। ৮ বিভাগে যে নতুন মেডিকেল কলেজ হচ্ছে সেখানেও মানসিক স্বাস্থ্য রাখা হয়েছে।
এ সময় জাতীয় মানসিক ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালেন সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ সভায় নানারকম তথ্য উপাত্ত তুলে ধরে বলেন, এই কর্মকৌশল বাস্তবায়নে একটা বডির প্রয়োজন। যেটি বিএমডিসি’র মাধ্যমে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য শুধু স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজ নয়, স্কুল-কলেজের শিক্ষকদেরও অনেক দায়িত্ব রয়েছে। আমাদের মনরোগ বিশেষজ্ঞ দরকার। কিন্তু এগুলোতে এখনো ঘাটতি রয়েছে। গত দুই বছরের আত্মহত্যা বেড়েছে। কিভাবে এটি রোধ করা যায় সেই কৌশল নিয়ে কাজ করতে হবে।
ডা. হেলাল বলেন, বাবা-মার পাশাপাশি সবার সচেতনতা বাড়ানো দরকার। আমাদের মনের যত্ন নিতে হবে। কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যারা চিকিৎসা দিচ্ছেন তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় এটি যুক্ত করতে হবে।
এর আগে অনুষ্ঠানের শুরুতে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে শিশুদের মাধ্যমে একটি চিত্রাংকন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় এবং অনুষ্ঠানে বিজয়ীদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেয়া হয়।
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব ড. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের সভাপতিত্বে সভায় অন্যদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন সূচনা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মিস সায়মা ওয়াজেদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবিএম খুরশীদ আলম, স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের মহাপরিচালক প্রফেসর আমিরুল মোর্শেদ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি সাধনা ভগবত, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রশাসন আহমেদুল কবীর সহ অন্যন্য কর্মকর্তারা।