প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাদ্য উৎপাদনের জন্য আবাদি জমি সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ দিয়ে বলেছেন, দেশ এরই মধ্যে অপরিকল্পিত শিল্পায়নের জন্য প্রচুর পরিমাণে ভালো মানের ও উর্বর জমি হারিয়েছে। তিনি বলেন,‘অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ণ এবং আবাসনের কারণে বিপুল পরিমাণ উর্বর আবাদি জমি হারিয়ে গেছে, কারণ পূর্ববর্তী সরকারগুলো এতে মনোযোগ দেয়নি। আমরা এ ধরনের জমি আর হারাতে চাই না।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার বিকেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমআরএইউ), গাজীপুরের ২৫তম বিশ্ববিদ্যালয় দিবস এবং প্রযুক্তি প্রদর্শনীর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এসব কথা বলেন। বিএসএমআরএইউর বেগম সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এ কর্মসূচিতে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দেন।
‘কোনো আবাদি জমি, যা সারা বছর তিন ধরনের ফসল উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয়, শিল্পায়নের জন্য ব্যবহার করা যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কেউ যদি এ ধরনের জমিতে শিল্প স্থাপন করে, তবে, তারা (সরকার থেকে) কোনো সুবিধা পাবে না এবং আমরা এই লক্ষ্যে এ ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ খুবই ছোট একটি দেশ কিন্তু মানুষের বিপুল সংখ্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য উৎপাদন নিরাপদ করতে আমাদের বিদ্যমান আবাদি জমি রক্ষা করতে হবে।’
পাশাপাশি তিনি বিজ্ঞানীদের গবেষণা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে গবেষণালব্ধ মেধাস্বত্ত (ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইট) যেন সঠিক উপায়ে সংরক্ষিত হয় তা নিশ্চিত করার এবং তার সরকারের প্রতিষ্ঠিত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তোলায় তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন।
কৃষি যেমন যান্ত্রিকীকরণ করতে হবে, তেমনি দক্ষ কৃষি উৎপাদনকর্মীও আমাদের তৈরি করতে হবে, পাশাপাশি সরকার শিল্পায়নকেও গুরুত্ব দেয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী অনুষ্ঠানে এ সময় বক্তৃতা করেন।
এতে আরো বক্তব্য দেন বিএসএমআরইউর উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. গিয়াসউদ্দীন মিয়া। অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর একটি তথ্যচিত্রও প্রদর্শিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাজ করতে গিয়ে অনেক বাধাও এসেছে, অনেক সমালোচনাও সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু আমরা সেই সাফল্য দেখাতে পারছি বলেই আমাদের কখনো খাদ্য ঘাটতি হয়নি। তার পরও আমাদের বন্যা হয়, খরা হয় নদীভাঙন হয়, ঝড় হয়, এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও অনেক সময় ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। কাজেই এই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মোকাবিলা করেই আমরা ফসল উৎপাদনের বহুমুখীকরণকে কাজে লাগাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার গোপালগঞ্জ জেলাসহ দক্ষিণাঞ্চলে প্রচুর কচুরিপানা হয়। সেগুলোকে বেঁধে মাচা করে ভাসমান চাষ পদ্ধতি এখন সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কেননা আমাদের জমির স্বল্পতা আছে সেদিকে লক্ষ রেখেই এ ব্যবস্থাটা নেওয়া হয়েছে।
তিনি দেশে ভোজ্য তেল উৎপাদন বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘আমাদের সরিষার তেল যেটা উৎপাদন হয় সেটাকে আমরা গবেষণা করে দেখেছি রিফাইন করে আরো হালকা ও উন্নতমানের করা যায়। বাদাম তেল, তিষি থেকে শুরু করে চালের কুড়া বা তুষ থেকেও তেল উৎপাদন হচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৯৮ শতাংশ ভোজ্য তেল আমাদের বাইরে থেকে রপ্তানি করতে হয়, সেটা আমরা কেন করব? কাজেই আমাদের তিল, তিষি ও বাদাম থেকে তেল উৎপাদনে আরো বেশি গবেষণা হওয়া দরকার এবং সেজন্য আপনাদের উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি এরই মধ্যে গবেষণার মাধ্যমে অনেক উন্নতমানের বীজ ও ফসলের জাত উদ্ভাবনে আমাদের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ধন্যবাদ জানান। কেননা জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষিবিজ্ঞানী ও কৃষিবিষয়ক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তবে আমি মনে করি যে আমাদের গবেষণা আরো গুরুত্ব দিতে হবে।
তার সরকার কৃষি সম্প্রসারণে গবেষণার জন্য উচ্চশিক্ষারও ব্যবস্থা নিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সহায়তা একটা ট্রাস্ট ফান্ড করা হয়েছে, সেখান থেকে আমরা উচ্চশিক্ষার জন্য সহযোগিতা করি। আর আমাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকেও গবেষণার জন্য ভালো একটা সহযোগিতা দেওয়া হয়। কাজেই এদিকে সবাইকে আরো দৃষ্টি দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, স্বল্প সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি গবেষণায় সব থেকে বেশি দক্ষতা দেখিয়েছে এবং অনেক উন্নত জাতের বা অধিক ফলনশীল ধান, বীজ, তৈলবীজ, সবজি, ফলমূল এবং বিভিন্ন ফসলের প্রায় ৬৭টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এরই মধ্যে গবেষণা করে ১২ মাসি কাঁঠালের জিনোম সিকোয়েন্স (জন্ম রহস্য উন্মোচন) আবিষ্কার করায় তাদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী এর মেধাস্বত্ত সংরক্ষণে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, পেঁয়াজ নিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হতো। এখন বীজ উদ্ভাবনের ফলে বছরে দুবার উৎপাদন করতে পারি। পেঁয়াজ সংরক্ষণে উদ্যোগ নিতে হবে। পেঁয়াজ-রসুন শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়। এ ছাড়া পেঁয়াজ ও রসুনের গুঁড়োও হয়।
গৃহপালিত পশুপাখির যত্ন নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বিষয়ে বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিকভাবে নানা সুযোগ আছে।
ভ্যাটেরিনারিতে যারা শিক্ষা গ্রহণ করেন তারা সবাই যে শিক্ষক হবেন বা চাকরি পাবেন সেটা নয়- এমন বাস্তবতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা কিন্তু নিজেরা কিছু কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারেন বা পশুসেবার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে নিজেই নিজের আয়ের পথ সুগম করতে পারেন।
গৃহপালিত পশু পালন করলেও পশুপাখির চিকিৎসা, তাদের আচার-আচরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া বা তাদের যত্ন দেওয়ার মতো বাংলাদেশে তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই বলে জানান শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগ সরকার কৃষি উৎপাদনে জোর দিচ্ছে উল্লেখ করে করোনাভাইরাস মহামারির পর বিশ্বব্যাপী মন্দা দেখা দিয়েছে এবং রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেওয়া নিষেধাজ্ঞার ফলে খাদ্যপণ্যের দাম, বিদ্যুৎ, পরিবহন, জ্বালানি, পরিবহন খরচসহ প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ার কথাও জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশ যেন এ ধরনের কোনো বিপদে না পড়ে। আমাদের উৎপাদন বাড়ানো এবং তা সংরক্ষণ করা দরকার। আমি এরই মধ্যে ধান রাখার জন্য কিছু আধুনিক সাইলো তৈরি করেছি, কিন্তু এটা আমাদের অন্যান্য ফসলের জন্যও খুব বেশি দরকার।’