বক্স অফিস চ্যাম্পিয়ন ‘অ্যাভাটার’ ছবির বহুল প্রতীক্ষিত সিক্যুয়েল প্রেক্ষাগৃহে চলছে । দীর্ঘ ১৩ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে গত ১৬ ডিসেম্বর বড় পর্দায় এসেছে ‘অ্যাভাটার: দ্য ওয়ে অব ওয়াটার’। বাংলাদেশেও মুক্তি পেয়েছে ছবিটি।
জেমস ক্যামেরনের ‘অ্যাভাটার’ ২০০৯ সালে তামাম দুনিয়ায় হইচই ফেলে দিয়েছিল। সর্বাধুনিক সিনেম্যাটিক গ্রাফিক্স এবং স্টোরিওস্কোপিক সাউন্ড সিস্টেম এতেই প্রথম ব্যবহার হয়। ছবিটি এখনও সর্বকালের সবচেয়ে বেশি আয়ের রেকর্ড ধরে রেখেছে। বিশ্বজুড়ে ২ দশমিক ৯২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে এটি, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৩০ হাজার ৪৩১ কোটি ১০ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে এর আয়কে ছাড়িয়ে গিয়েছিল মারভেল স্টুডিওসের ‘অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম’।
গত বছর চীনে নতুনভাবে মুক্তির পর সর্বকালের সবচেয়ে লাভজনক ছবির তালিকায় আবারও শীর্ষে উঠে আসে ‘অ্যাভাটার’। এর সিক্যুয়েলের জন্য উন্মুখ ছিলেন অসংখ্য দর্শক। ‘অ্যাভাটার: দ্য ওয়ে অব ওয়াটার’ নিয়ে যেসব কৌতূহল তৈরি হয়েছে, চলুন জেনে নিই সেগুলো।
২০০৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অ্যাভাটার’ ছবির গল্পে দেখা গেছে, পক্ষাঘাতগ্রস্ত নৌবাহিনীর সদস্য জ্যাক সালি প্রযুক্তি ব্যবহার করে পৌঁছায় প্যান্ডোরা গ্রহে। সেখানে মানুষের মতোই বাহ্যিক আকার সম্পন্ন না’ভির একজন হয়ে যায় সে। না’ভি সম্প্রদায়ের প্রত্যেকে ৯ ফুট লম্বা, নীল রঙা ও লেজ বিশিষ্ট।
প্যান্ডোরার মূল্যবান খনিজ সম্পদ ‘আনঅবটেনিয়াম’ দখল করতে আসে পৃথিবীর অধিবাসীদের একদল প্রতিনিধি। কারণ পৃথিবী গ্রহের শক্তির সব উৎস শেষ হয়ে এসেছে। না’ভিরা নিজেদের গ্রহের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বদ্ধপরিকর। তাই শুরু হয় মানুষের সঙ্গে তাদের সংঘাত।
‘অ্যাভাটার’ যেখানে শেষ হয়েছিল, সেখান থেকে ১০ বছর পর শুরু হয় নতুন ছবির গল্প। এটি দর্শকদের আবারও প্যান্ডোরা গ্রহে নিয়ে যাবে, যেখানে না’ভিদের অস্তিত্ব ফের হুমকির মুখে পড়ে। জেমস ক্যামেরন এবার একটি জলজ ভুবন সৃষ্টি করেছেন। নতুন পর্বে আরও বেশি কাল্পনিক চরিত্রের সমাহার ঘটিয়েছেন তিনি। প্যান্ডোরা গ্রহে এবার দেখা যাবে তিমির মতো প্রাণী, বিশাল উড়ন্ত মাছসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী।
নতুন ছবিতে দেখা যাবে, জ্যাক সালি ও নেইতিরি দম্পতি এখন পাঁচ সন্তানের বাবা-মা। পৃথিবী থেকে আসা মানুষের কারণে তাদের শান্তিপূর্ণ জীবনে সংকট নেমে আসে। জ্যাক, নেইতিরি ও তাদের সন্তানেরা সমুদ্রের মেটকাইনা গোষ্ঠীর কাছে আশ্রয় চেয়ে দূরবর্তী অঞ্চলে সরে যায়। শত্রুদের হুমকি মাথায় নিয়ে সমুদ্রজলে বেঁচে থাকার উপায় শিখতে থাকে তারা।
‘অ্যাভাটার’ মুক্তির একবছর পর ২০১০ সালে টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স (পরে ডিজনির কাছে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি হয়েছে) জানায়, এর দুটি সিক্যুয়েল আসতে পারে। এরমধ্যে প্রথমটি ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু পরের কয়েক বছর নিয়মিত বিরতিতে জানা গেছে, ‘অ্যাভাটার টু’র মুক্তি পিছিয়ে গেছে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পেরিয়ে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর এলো, এরপর ২০১৭ সালের ডিসেম্বর গেলো, তারপর ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পেরোলো। অবশেষে আজ বিশ্বব্যাপী মুক্তি পেয়েছে ছবিটি।
কানাডিয়ান পরিচালক, গল্পকার জেমস ক্যামেরন ‘অ্যাভাটার’-এর সিক্যুয়েলের একটি সংস্করণ লিখে নিজেরই পছন্দ না হওয়ায় ফেলে দিয়েছিলেন। তিনি ওই চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের বাইরে ৬২ বছর বয়সী এই নির্মাতার অন্য একটি জীবন আছে। তিনি সমুদ্রের গভীরে গিয়ে নানান গবেষণায় বেশকিছু সময় কাটিয়েছেন। যদিও তার সেই কার্যক্রম সিক্যুয়েলটির জন্য গবেষণা হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে! কারণ এবারের পর্বের পটভূমির বেশিরভাগই জল ও সমুদ্রের তলদেশ।
‘অ্যাভাটার: দ্য ওয়ে অব ওয়াটার’-এর চিত্রনাট্য যৌথভাবে সাজিয়েছেন জেমস ক্যামেরন এবং রিক জাফা ও আমান্ডা সিলভার দম্পতি। তাদের সঙ্গে মিলে গল্পটি যৌথভাবে লিখেছেন জশ ফ্রিডম্যান ও শেন স্যালেরনো। বাকি লেখকদের সঙ্গে কাজে নামার আগে তাদের ৮০০ পৃষ্ঠার নোট পড়তে দেন জেমস ক্যামেরন। এগুলো ছয় মাস ধরে লিখেছেন তিনি। দর্শকদের মন ও কল্পনা ছুঁয়ে যেতে পারে এমন গ্রহ, গল্প ও নতুন চরিত্র সাজাতে দীর্ঘ সময় ধরে ভেবেছেন তিনি।
জেমস ক্যামেরনের সবচেয়ে দীর্ঘ চলচ্চিত্র ‘টাইটানিক’। এর দৈর্ঘ্য ৩ ঘণ্টা ১৫ মিনিট। তবে ‘অ্যাভাটার: দ্য ওয়ে অব ওয়াটার’ ছবির ব্যাপ্তি ৩ ঘণ্টা ১২ মিনিট।
জ্যাক সালি ও নেইতিরি চরিত্রে অভিনয় করেছেন যথারীতি স্যাম ওয়ার্থিংটন ও জোয়ি স্যালডানা। আগের পর্বের অন্য অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে ফিরছেন সিগোর্নি উইভার, স্টিফেন ল্যাং, ম্যাট জেরাল্ড, জোয়েল ডেভিড মুর, দিলীপ রাও।
সিক্যুয়েলে নতুন যুক্ত হয়েছেন অস্কারজয়ী কেট উইন্সলেট, এডি ফালকাও, মিশেল ইও, ভিন ডিজেল, জিমেইন ক্লেমেন্ট, জিওভানি রিবিসি, ওনা চ্যাপলিন, জ্যাক চ্যাম্পিয়ন, জেমস ফ্ল্যাটার্স, বেইলি বেজ, ট্রিনিটি জো-লি ব্লিস।
‘টাইটানিক’ তারকা কেট উইন্সলেট ২৫ বছর পর আবারও জেমস ক্যামেরনের পরিচালনায় অভিনয় করলেন। মেটকাইনা বংশের মেয়ে রোনাল চরিত্রে দেখা যাবে তাকে। এজন্য পানির ২০ ফুট গভীরে সাত মিনিট পর্যন্ত দম ধরে রেখে ডুবে অভিনয়ের কৌশল রপ্ত করেন তিনি।
ছবিটির প্রসংগে জেমস ক্যামেরন বলেন, আমি কেবলই ব্যক্তিগত স্ট্রিমিং সার্ভিসের স্বপ্নে বিভোর, যেটি প্রতি রাতে বিনামূল্যে চলতে থাকে। মনে হয় আমি স্বপ্নে অনেক কাজ করি এবং অনেক ছবি দেখি। কখনও কখনও ঘুম ভেঙে উঠে সেসব লিখেছি। কলেজে অধ্যয়নকালেই ‘অ্যাভাটার’-এর জন্য কিছু জিনিস নিয়ে লাফিয়ে উঠে ছবি এঁকেছিলাম। ছবিটি নির্মাণ করা আমার অনেকদিনের ইচ্ছে। আমি সবসময় স্বপ্ন দেখেছি, চারপাশে সাঁতার কাটতে থাকা চমৎকার সব প্রাণীর সঙ্গে ঘুরে বেড়াবো। তাই অবচেতন মনে আঁকা সেইসব চিত্র বড় পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছি।
জেমস ক্যামেরনের পরিশ্রম বিফলে যাবে না বলে মনে হচ্ছে। চলচ্চিত্র বোদ্ধারা ‘অ্যাভাটার: দ্য ওয়ে অব ওয়াটার’-এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। জেমস ক্যামেরনের শৈল্পিকতায় তারা বিস্মিত। রোটেন টমেটোস ওয়েবসাইটে ৮৫ শতাংশ বোদ্ধা নতুন কিস্তিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। কারও চোখে, এটি বেশ চমকপ্রদ। কেউবা মন্তব্য করেছেন, ছবিটি দারুণ বিনোদনমূলক। ভ্যারাইটির পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, এবারের পর্ব দর্শকের চোখ ছানাবড়া ও মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে! সেই সঙ্গে তাদের মন ধড়ফড় করছে। হলিউড রিপোর্টারের দৃষ্টিতে, ছবিটিতে অ্যাকশন, আবেগ ও রোমাঞ্চকর সর্বাধুনিক ত্রিমাত্রিক মনোরম দৃশ্য রয়েছে। এর দারুণ ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার মতো। ডেইলি মেইলের মন্তব্য, আগের ছবির চেয়ে নতুন পর্ব অসাধারণ এবং চমৎকার।
জেমস ক্যামেরন এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন, ২০০ কোটি মার্কিন ডলার আয় করলেই খরচ উঠে যাবে প্রযোজকদের। বক্স অফিসের মোট আয়ের দুই-তৃতীয়াংশ আমেরিকার বাইরে থেকে আসবে। আর চূড়ান্ত সাফল্য মূলত চীনের ওপর নির্ভর করবে। যদিও জিরো-কোভিড নীতির কারণে চীনে অনেক প্রেক্ষাগৃহ এখন বন্ধ।
তবে করোনা মহামারির ধাক্কা ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মের দৌরাত্ম্য বদলে দিয়েছে ছবির বাজার। তাই ব্যয়বহুল ‘অ্যাভাটার: দ্য ওয়ে অব ওয়াটার’-এর সামনে চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘ বিরতির পর আসার কারণে সিক্যুয়েলটি নিয়ে দর্শকদের আগ্রহ সমান আছে কিনা সেই প্রশ্ন উঠেছে। অবশ্য গত মে মাসে ‘অ্যাভাটার: দ্য ওয়ে অব ওয়াটার’-এর টিজার ট্রেলার প্রকাশের প্রথম ২৪ ঘণ্টায় দেখা হয়েছে ১৪ কোটি ৮৬ লাখ বার।
আরও কয়টি সিক্যুয়েলের পরিকল্পনা করা হয়েছে
‘অ্যাভাটার: দ্য ওয়ে অব ওয়াটার’সহ বর্তমানে মোট চারটি সিক্যুয়েলের পরিকল্পনা করেছেন জেমস ক্যামেরন। ‘অ্যাভাটার থ্রি’ আসবে ২০২৪ সালের ২০ ডিসেম্বর। ছবিটির চিত্রায়ন ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। ২০২৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর ‘অ্যাভাটার ফোর’ এবং ২০২৮ সালের ২২ ডিসেম্বর মুক্তি পাবে ‘অ্যাভাটার ফাইভ’। চতুর্থ কিস্তির কিছু অংশের চিত্রায়ন হয়েছে। আর পঞ্চম পর্বের চিত্রনাট্য চূড়ান্ত করে রাখা হয়েছে।
২০১৯ সালে ‘অ্যাভাটার’ ফ্র্যাঞ্চাইজি কিনে নেয় ডিজনি। এজন্য তাদের গুনতে হয়েছে ৭১০ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬৭ হাজার ৯৯৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। তবে ‘অ্যাভাটার’-এর পরের কিস্তিগুলোর ভবিষ্যৎ কিছুটা অনিশ্চিত। কারণ বিশাল বাজেট। ‘অ্যাভাটার: দ্য ওয়ে অব ওয়াটার’ তৈরিতে খরচ হয়েছে ৩৫ কোটি মার্কিন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩ হাজার ৬১৬ কোটি ৭৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। হলিউডের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ছবির তালিকায় এটি অন্যতম।