ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছেন, জরুরি পরিস্থিতির উদ্ভব হলে চীন চুপচাপ বসে থাকবে না, বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে।
বাংলাদেশে জ্বালানির চরম সংকট দেখা দিলে চীন বাংলাদেশের পাশে থাকবে কি না এবং যেকোনো উৎস থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি করবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে লি জিমিং বলেন, চীন এলএনজিসহ নানা ধরনের জ্বালানি আমদানি করে থাকে। তাই এসব জ্বালানি বাংলাদেশে রপ্তানির মতো অবস্থা চীনের নেই। যদি কোনো জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হয়, তবে সব সময়ের মতো চীন চুপচাপ অলস বসে না থেকে পদক্ষেপ নেবে। তিনি জানান, বাংলাদেশ সরকারের কিছু প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে। বাংলাদেশের অনুরোধের বিষয়টি বেইজিংকে জানানো হয়েছে। বাংলাদেশকে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি খাতে সহযোগিতায় চীন আগ্রহী। কারখানা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির লক্ষ্যে সোলার প্যানেল প্রতিষ্ঠায় চীনের কোম্পানি বিনিয়োগ করতে চায়।
বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ডিপ্লোমেটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ডিকাব) আয়োজিত ‘ডিকাব টক’ অনুষ্ঠানে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এ কথা বলেন।
চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, বেইজিংয়ের মূল উদ্দেশ্য হল এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পশ্চিমা পরামর্শে কান না দিয়ে ‘এশীয় উপায়ে’ সমস্ত আঞ্চলিক বিরোধের সমাধান করা।
তিনি বলেন, ‘আমরা (চীন) বিশ্বাস করি, আমাদের আঞ্চলিক সমস্যাগুলো এশীয় পদ্ধতিতে সমাধান করা উচিত… ইউরোপীয় মানের পদ্ধতি (এখানে) অনুশীলনের মাধ্যমে নয়।’
রাষ্ট্রদূত বলেন, বেইজিং বঙ্গোপসাগরকে ভারী অস্ত্র-সজ্জিত হিসেবে দেখতে পছন্দ করে না এবং আশা করে যে এখানকার সব আঞ্চলিক দেশ এক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করি … সমস্ত অংশীজনদের একটি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করা উচিত। কিছু দেশ (বর্তমানে) ইউরোপে যেভাবে কাজ করছে (সেভাবে) কাজ করা উচিত নয়।’
ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, ভারতের সঙ্গে চীনের কোনো কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা বৈরিতা নেই। ‘আমরা আশা করি যে এক বিলিয়নেরও বেশি জনসংখ্যার দেশ চীন এবং ভারত উভয়েই অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য সমস্যা সমাধানে একসাথে কাজ করতে পারবে।’ তিনি যোগ করেন।
তিনি বলেন, এই অঞ্চলে উন্নয়ন, শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বেইজিং বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে আগ্রহী।
রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি এমনকি অটোমোবাইল তৈরির মতো উচ্চ পর্যায়ের শিল্পায়নে যেতে প্রস্তুত। ‘অবকাঠামো আছে… পাওয়ার প্ল্যান্ট আছে… অভ্যন্তরীণ বাজার অনেকখানি উন্নত হয়েছে… (সমুদ্র) বন্দর… প্রায় সবকিছু… (বাংলাদেশে) উচ্চ পর্যায়ের শিল্পায়নের জন্য প্রস্তুত,’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, চীনও এই লক্ষ্য অর্জনে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত।
বিশ্ব অর্থনীতির ১৮.৫ শতাংশের অংশীদার একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে চীন সবসময় বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলো সাথে যৌথ উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি আরেও বলেন, ‘চীনা কোম্পানি এবং চীনা জনগণ বাংলাদেশকে খুবই ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শান্তি এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পূর্বশর্ত উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন যে বাংলাদেশ ‘শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক উপায়ে’ অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হবে।
ইউক্রেন ইস্যুতে তিনি বলেন, চীন বাংলাদেশের সঙ্গে অভিন্ন অভিমত পোষণ করে। ‘আমরা উভয়েই শান্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছি এবং কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে সকলের উদ্বেগের যথাযথ নিষ্পত্তির আহ্বান জানাই,’ তিনি যোগ করেন।
রোহিঙ্গা ইস্যু প্রসঙ্গে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, সংকটর টেকসই সমাধানে বেইজিংয়ের মূল লক্ষ্য হচ্ছে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষদের বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করা। তিনি আরও বলেন, ‘তাদের (রোহিঙ্গাদের) অবশ্যই (মিয়ানমারে) যেতে হবে।
লি বলেন, মিয়ানমারে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত রোহিঙ্গারা যাতে তাদের আদিভূমিতে ফিরে যেতে পারে সেজন্য রাখাইনে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে নেপিদো কর্তৃপক্ষের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন ।
তিনি বলেন, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ইতিবাচক। তবে, বর্তমানে তারা প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য রাখাইন রাজ্যে বর্তমান সংঘাত নিয়ন্ত্রণের জন্য অপেক্ষা করছে।
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা মোকাবিলা করার জন্য আমরা বাংলাদেশের প্রশংসা করি।’
রাষ্ট্রদূত ঋণ ব্যবস্থাপনা, বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়েও কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে চীনা ঋণের ফাঁদ নেই। বিশ্বব্যাপী কোনো চীনা ঋণের ফাঁদ নেই।’
রাষ্ট্রদূত বলেন, তার দেশ দুটি দেশের মধ্যে বাণিজ্য ব্যবধান কমাতে কাজ করছে যা বর্তমানে মূলত চীনের পক্ষে। চীনা পক্ষের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২২ সালের প্রথম আট মাসে, চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে পণ্য বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৮.৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বছরে ২৩.৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সেপ্টেম্বরে ৯৮ শতাংশ শূন্য-শুল্ক ট্রিটমেন্ট কার্যকর হওয়ার সাথে সাথে এটি আশা করা হচ্ছে যে চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়বে, বাণিজ্য হিসাব আরও ভারসাম্যপূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
অনুষ্ঠানে ডিকাব সভাপতি রেজাউল করিম লোটাস ও সাধারণ সম্পাদক একেএম মঈনুদ্দিন বক্তব্য রাখেন।
সূত্র বাসস।