বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরকে ভারতীয় পত্রিকাগুলো একটি সফল সফর হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছে, ‘এই সফর ঢাকা-দিল্লী সম্পর্ক গভীর হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে।’
এই সফরের সাফল্য তুলে ধরে দেশব্যাপী ভারতীয় বিভিন্ন পত্রিকা, সংবাদ সংস্থা ও অনলাইন পোর্টালে হিন্দি, ইংরেজি ও বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় প্রখ্যাত সাংবাদিকদের হার্ড স্টোরির পাশাপাশি সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় ও নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর এই সফরটি এনডিটিভি, টাইমস নাও টিভি, রিপাবলিক টিভি ও সংসদ টিভির মতো ভারতীয় ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়ও গুরুত্ব দিয়ে সম্প্রচার করা হয়। এই চ্যানেলগুলোতে প্রধানমন্ত্রীর সফরের ওপর অনুষ্ঠান ও টক শো সম্প্রচার করে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখ থেকে ৮ তারিখ পর্যন্ত ভারতে চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফর করেন।
এই সফরকালে যোগযোগ, পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য, রপ্তানি ও গণমাধ্যম বিষয়সহ সাতটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়।
রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ যখন বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন ও জ্বালানী বাজারে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, ঠিক সেই চলমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দ্বিপাক্ষিক, বহুপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যু নিয়ে দুই নেতার মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে। এ কারণেই ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো এই সফরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখেছে।
৯ সেপ্টেম্বর, ভারতীয় পত্রিকা দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ‘শেখ হাসিনার সফর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের গভীরতার ইঙ্গিত। আঞ্চলিক অস্থিরতার সময়কে সযত্নে মোকাবেলা করতে হবে’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়।
সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এমন এক সময় সম্পর্ক আরো গভীর হলো- যখন দক্ষিণ এশিয়ায় অনিশ্চয়তা বেড়েই চলছে। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে ভুগছে। এমনকি গোটা অঞ্চলটিকেই এখন করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ চেইনে সমস্যার মতো জোড়া অভিঘাত মোকাবিলা করতে হচ্ছে।’
এতে আরো বলা হয়, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও সংযোগ বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এই ভারত সফরকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
ভারতের স্বনামধন্য কৌশল বিশ্লেষক কে পি নায়ার দি টিব্রিউনে এক উপসম্পাদকীয়তে লিখেন যে- বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গত সপ্তাহের ভারত সফরটি ছিল ইতিহাসের নিজেরই পুনরাবৃত্তি।
তিনি বলেন, সম্ভাব্য ভবিষ্যত অস্থিরতা এড়িয়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে ৩০ বছর আগে নয়াদিল্লী পি ভি নরসিংমা রাওয়ের কূটনীতি গ্রহণ করেছিল। আর এটি ছিল ভারতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিবেশীর সাথে শান্তির নীতি। এই শান্তির নীতিটি বিশেষত গত এক দশক ধরে উভয় দিক থেকেই অব্যহত রয়েছে।
তিনি আরো লিখেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে উভয় পক্ষই সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তির (সিইপিএ) ওপর আলোচনা শুরু করতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়। ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যবসায় অংশীদার এবং এশিয়ায় এর বৃহত্তম রপ্তানি বাজার।
নায়ার বলেন, মহামারি সত্ত্বেও দু’দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল অভূতপূর্ব প্রায় ৪৪ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০.৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৮.১৩ বিলিয়নে দাঁড়ায়।
তিনি বলেন, এছাড়াও স্থল সীমান্ত ও নদীর পানি ব্যবস্থাপনা উভয় ক্ষেত্রেই তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ওআরএফ) এ স্টাডিজ অ্যান্ড ফরেন পলিসির ভাইস প্রেসিডেন্ট হর্ষ ভি পান্ত দি হিন্দুস্তান টাইমসের মতামত কলামে ৯ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর সম্পর্কে লিখেন, ‘দিল্লী-ঢাকা সম্পর্ক একটি নতুন সোনালী যুগে প্রবেশ করল।’
তিনি লিখেন, ‘এ সপ্তাহে বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরটি দুটি প্রতিবেশী দেশের পাশাপাশি একটি অঞ্চলের দু’দেশের জনগণের মধ্যে অকৃত্রিম বন্ধন তুলে ধরেছে।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত রাজীব ভাটিয়া সংবাদপত্রের একটি নিবন্ধে লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে রাষ্ট্রীয় সফর ‘আঞ্চলিক তাৎপর্যে অনুপ্রাণিত তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উভয় দেশের উচ্চ অবস্থানকে ব্যাপকভাবে প্রদর্শন করেছে।’
১২ সেপ্টেম্বর স্থানীয় দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’-তে প্রকাশিত ‘দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার একটি মডেল, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক’ শিরোনামে সাবেক রাষ্ট্রদূত লিখেছেন, বিশেষ বন্ধন লালন করার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরকারের অবদানকে স্বীকার করা দরকার।
বাংলাদেশে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে এক নিবন্ধে লিখেছেন, শত্রু শক্তি সদিচ্ছাকে ক্ষুন্ন করতে চাইলেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বাড়তে থাকবে।
৯ সেপ্টেম্বর দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ বলা হয়েছে ‘ভারত ও বাংলাদেশের পরিপক্ক নেতৃত্ব ছোটখাটো মতবিরোধ ও স্বার্থের ভাগাভাগিকে হুমকি হতে দেয়নি’- শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধে লেখা হয় যে, ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিরাপদ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে উভয় দেশকে এই হুমকির বিরদ্ধে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করতে হবে।
সাম্প্রতিক সফরে তিনি লিখেন, সংযোগ, পরিবেশ, পানি ব্যবস্থাপনা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, রেলওয়ে, আইন, তথ্য ও সম্প্রচারের মতো খাতে সাতটি চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে এবং পাঁচটি নতুন অবকাঠামো প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে।
নিবন্ধে বলা হয়েছে যে, ‘উল্লেখযোগ্যভাবে আসামের শিলচর জেলা থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত কুশিয়ারা নদীর পানিবন্টনের জন্য একটি চুক্তি রয়েছে। ভারত ফেনী নদীর উপর অস্থায়ী পানিবণ্টন চুক্তি চূড়ান্ত করার জন্য অনুরোধ করে, যা ত্রিপুরার পানি প্রয়োজন পূরণ করছে।’
তিস্তা ইস্যু নিয়ে তিনি লিখেছেন, অমীমাংসিত তিস্তা চুক্তি ভারতে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের টানাপোড়নে আটকে আছে। ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদনদীর পানি বন্টন এবং বন্যার তথ্য পরীক্ষা যৌথ নদী কমিশনের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাদের জীবন উৎসর্গকারী ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সন্তানদের জন্য ২০০টি বৃত্তি ঘোষণা করেছে। যুদ্ধে যোগদানকারী প্রবীণ সৈনিক ও তাদের পরিবারের চিকিৎসা সুবিধা প্রদানের জন্য ভারতের একটি কর্মসূচি রয়েছে। এই ব্যবস্থাগুলো জনগণের পারস্পরিক বন্ধন দৃঢ় করেছে।
কম্প্রিহেনসিভ ইকোনোমিক পার্টনারশীপ এগ্রিমেন্ট (সিইপিএ) নিয়ে শিগগিরই আলোচনা শুরু হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে এবং আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তির অধীনে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে দেওয়া বাণিজ্য ও অন্যান্য সুবিধা আর পাবে না।
তবে, তিনি জানান, ‘সিইপিএ এই পরিবর্তন পরিচালনা করতে এবং বাংলাদেশ যে বাণিজ্য সুবিধা ভোগ করে তা সংরক্ষণ করতে সহায়তা করবে।’
সাংবাদিক ও কলামিস্ট সুবিমল ভট্টাচার্য বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর আগামী কয়েক বছরের জন্য প্রাথমিকভাবে অর্থনীতিক ও সংযোগসহ বিভিন্ন ফ্রন্টে সহযোগিতার গতিশীলতা এনে দেবে।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ৮ সেপ্টেম্বরের সংখ্যার এক উপ-সম্পাদকীয়তে লেখা হয় যে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে উন্নত যোগাযোগ কেবল অর্থনৈতিক সম্ভাবনাই বাড়ায় না বরং জনগণের মধ্যে আরও ভাল সম্পর্ক ও সৃষ্টি করে।
তিনি লিখেছেন, উভয় দেশ একই সঙ্গে তাদের নিজ নিজ দেশে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীদের নিরঙ্কুশ নেতৃত্বের আট বছরে অনেক দীর্ঘস্থায়ী মাইলফলক অর্জিত হয়েছে, এই সফর পরবর্তী কয়েক বছরের জন্য প্রাথমিকভাবে অর্থনীতি, সংযোগ ও বিবিধ সহযোগিতার দ্বার উন্মোচিত হবে।
ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক এবং বাংলাদেশ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ গৌতম লাহিড়ী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিতে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে কীভাবে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায় তার একটি নির্দেশিকা তৈরি হয়েছে।
বাসসের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, কুশিয়ারার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ৫৪টি অভিন্ন নদনদীর পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের দাবি বাস্তবায়নের যাত্রা শুরু হয়েছে।
ভারত নেপাল ও ভুটানে তার পণ্য রপ্তানি করতে বাংলাদেশকে করমুক্ত ট্রানজিট দিতে সম্মত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ নেপাল ও ভুটান থেকে যাতে করে বিদ্যুৎ আমদানি করতে পারে সেই লক্ষ্যে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়া (পিসিআই)-এর সাবেক সভাপতি লাহিড়ী বলেন, ‘এসব বিষয় বিবেচনা করে, আমরা বলতে পারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর ছিল একটি সফল সফর যেখানে দুই দেশের মধ্যে অনেক জমে থাকা সমস্যার সমাধান হয়েছে।’
সূত্র বাসস