বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে বাদ দেওয়ায় নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মমতা ব্যানার্জি।
ভারত সফরে যাওয়ার আগে স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকন্যা চিঠি লিখে মমতার সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু পররাষ্ট্রনীতির প্রটোকল মেনে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তাদের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে দিল্লিতে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার কোনো কর্মসূচি রাখেনি।
শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা না করতে পেরে ক্ষুব্ধ মমতা বৃহস্পতিবার কলকাতায় নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘হাসিনাজি দিল্লিতে এসেছেন। আমার সঙ্গে উনার ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুবই ভালো। ওদের সকলের সাথে। আজকে নয়, চিরকাল। কিন্তু দেখা করতে দিল না।পুজোর সময়ে আমি উনাকে চিঠি দিই। উনি আমাকে শাড়ি পাঠান, আম পাঠান, কখনও ইলিশ পাঠান। আমি শুনেছি, উনি এ সফরে আমার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু দিল্লি তা শোনেনি। এই প্রথম দেখলাম, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দিল্লিতে এসেছেন, অথচ বাংলাকে বাদ দেওয়া হলো।’ মমতা ব্যানার্জি অবশ্য এদিন কলকাতায় তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মসূচিতে বোঝাতে চান যে পুরো ব্যাপারটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে করেছে নয়াদিল্লি। কারণ, দিল্লির ক্ষমতাসীন বিজেপির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক লড়াই এখন চরমে।
এরপর মমতা হিন্দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এত রাগ কিসের? বড় লোকেদের এত ভয়ের কি আছে? শিকাগো থেকে আমার আমন্ত্রণ এসেছিল; কিন্তু আটকে দিয়েছে, আমাকে যেতে দেওয়া হয়নি। দিল্লির স্টিফেন্স কলেজ থেকে আমন্ত্রণ এসেছিল, আটকে দিয়েছে, যেতে দেওয়া হয়নি। চীন থেকে আমন্ত্রণ এসেছিল, সেখানেও আটকে দেওয়া হয়েছে, যেতে দেওয়া হয়নি। বাংলায় ঘুরলেই সারা বিশ্ব ভ্রমণ হয়ে যায়। তাই বাইরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের পরিসরে গত ৫০ বছরে অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বা সাংস্কৃতিক সম্পর্কের নিরিখে তা শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের নিরাপত্তার বিষয়ও তাতে জড়িত রয়েছে। সার্বিক সেই প্রেক্ষাপটে অতীতে বারবার দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে এলে পশ্চিমবঙ্গের বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার আপত্তির জেরেই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি আজও সম্পাদিত হয়নি। এদিন মমতার এই ক্ষোভ নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সন্ধ্যা পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলতি বছর ১৯ জুলাই এক শুভেচ্ছা বার্তায় মমতাকে বলেছিলেন, সুবিধাজনক সময় বাংলাদেশ সফরের জন্য আমন্ত্রণ রইল। সেপ্টেম্বরে ২০২২-এ আমার নির্ধারিত নয়াদিল্লী সফরকালে আপনার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে আশা রাখি। দুই বাংলার ভাষা, সংস্কৃতি ও আদর্শগত সাদৃশ্যের ওপর ভিত্তি করে বিদ্যমান সম্পর্কের দৃঢ়তর করতে একযোগে কাজ করার বিকল্প নেই।
গত ৫ সেপ্টেম্বর মমতা বলেছিলেন, সারা পৃথিবীতে আমাকে বক্তৃতা দিতে ডাকলেও আমি যেতে পারি না। কারণ, আমাকে যেতে দেওয়া হয় না। তাতে কোনো যায় আসে না। আজকে পবিত্র দিন, ৫ সেপ্টেম্বর, শিক্ষক দিবস। আমি জানি আজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, দিল্লিতে এসেছেন। ভারতবর্ষে ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর অব্দি উনি আছেন। আমার ও পশ্চিমবাংলার মানুষের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে শুভেচ্ছা, অভিনন্দন এবং আমরা প্রণাম ও সালাম জানাই।
মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ওখানকার (বাংলাদেশ) শিক্ষকদেরও শ্রদ্ধা জানাই। কারণ, সংস্কৃতির দিক থেকে ওদের-আমাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আর যারা অ-বাঙালি আছেন তারা মনে রাখবেন আমাদের একটাই ধর্ম। সেটা হলো মানবিক ধর্ম। মনে রাখবেন, আমরা যেটা বারবার বলি, ধর্ম যার যার উৎসব সবার। ধর্ম কারোও ব্যক্তিগত বিষয় হতে পারে, কিন্তু উৎসব সবার।
এর আগে, ২০১৮ সালের ২৬ মে কলকাতার তাজ বেঙ্গলে চল্লিশ মিনিট বৈঠক হয়েছিল হাসিনা-মমতার। সেবার দুদিনের সরকারি সফরে কলকাতায় এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের অংশগ্রহণ করেন তিনি। পরে পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানসূচক ডক্টর অব লিটারেচার (ডি.লিট) উপাধিতে ভূষিত হন শেখ হাসিনা।
এরপর ২০১৯ সালে বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার (বিসিসিআই) সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলির আমন্ত্রণে কলকাতায় এসেছিলেন বাংলাদেশের সরকার প্রধান। কলকাতার ইডেন গার্ডেনে ভারত-বাংলাদেশ দিনরাতের গোলাপি বলে ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেবারও দুই বাংলার হাসিনা-মমতা সাক্ষাৎ হয়েছিল।