প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, ষড়যন্ত্রের ফলে আমাদের সেতু নির্মাণ দুই বছর বিলম্বিত হয়েছে। কিন্তু আমরা হতোদ্যম হইনি। শেষ পর্যন্ত অন্ধকার ভেদ করে আমরা আলোর মুখ দেখেছি। দেশি-বিদেশি সকল ষড়যন্ত্র এবং বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে পদ্মা সেতুর স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ পেয়েছে।
বুধবার জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তরে সরকারি দলের মেরিনা জাহানের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রশ্নোত্তর টেবিলে উত্থাপিত হয়।
তিনি বলেন, এ সেতুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগ, সৃজনশীলতা, সাহসিকতা, সহনশীলতা এবং প্রত্যয়। আমরা এ সেতু করবোই, সেই জেদ। শেষ পর্যন্ত অন্ধকার ভেদ করে আমরা আলোর মুখ দেখেছি। পদ্মার বুকে জ্বলে উঠেছে লাল, নীল, সবুজ, সোনালি আলোর ঝলকানি। ৪২টি স্তম্ভ যেন স্পর্ধিত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না, পারেনি। আমরা বিজয়ী হয়েছি।
শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া পয়েন্টে আনুষ্ঠানিকভাবে আমি পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করি। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে মাওয়া প্রান্তে সেতু নির্মাণের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। তারা জাপান সরকারকে পুনরায় মানিকগঞ্জের আরিচা প্রান্তে পদ্মা সেতুর জন্য সমীক্ষা করতে বলে। দ্বিতীয়বার সমীক্ষার পর জাপান মাওয়া প্রান্তকেই নির্দিষ্ট করে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিবেদন পেশ করে।
২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর পদ্মা সেতু নির্মাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সেতুর বিস্তারিত ডিজাইন প্রণয়নের লক্ষে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং প্রকল্পের বিভিন্ন প্যাকেজে বিস্তারিত ডিজাইন চূড়ান্ত করা হয়। ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) এর সাথে ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
ঠিকাদার নিয়োগে টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু হলে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রকল্পের বিভিন্ন প্যাকেজের নির্মাণ কাজ তদারকির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা এবং আইডিবি ঋণচুক্তি স্থগিত করে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে কানাডার টরেন্টোর একটি আদালতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পে পুনরায় ফিরে আসার ঘোষণা দিলেও দেশ-জনগণের স্বার্থে বিশ্বব্যাংকের ঋণ গ্রহণ না করে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। বহু কাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু প্রকল্পের সূচনালগ্নে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র, চ্যালেঞ্জসমূহের উত্তরণ এবং হার না মানা সুদৃঢ় মনোবলের মাধ্যমে সব প্রতিকূলতাকে জয় করে এ সেতু আজ স্বপ্ন নয়, একটি দৃশ্যমান বাস্তবতা।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনে শুকরিয়া আদায় করে তিনি বলেন, এতে কোটি কোটি দেশবাসীর সঙ্গে আমিও আনন্দিত, গর্বিত এবং উদ্বেলিত। অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে আর ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে প্রমত্তা পদ্মার বুকে আজ বহু-কাঙ্ক্ষিত সেতু দাঁড়িয়ে গেছে। এ সেতু শুধু ইট-সিমেন্ট-স্টিল-লোহা-কংক্রিটের একটি অবকাঠামো নয়; এ সেতু আমাদের অহংকার, গর্ব, সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক। এ সেতু বাংলাদেশের জনগণের।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার (ঢাকা-৪) এক প্রশ্নের উত্তরে সংসদ নেতা বলেন, করোনা ভাইরাস অতিমারির কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন ও সরবরাহ হ্রাস পায়। উপরন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। যুদ্ধের কারণে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থার অবনতি ঘটে বিধায় সমগ্র বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি দেখা দেয় এবং নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বাংলাদেশের দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সরবরাহ অব্যাহত রাখা সম্ভব হচ্ছে।
তিনি বলেন, আপনাদের সদয় অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে; মে ২০২২ মাসে ব্রিটেনে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৯%, যুক্তরাষ্ট্রে ৮%, ভারতে ৭.৯% এবং তুরস্কে ৫৪.৮%। এসময়ে বাংলাদেশে খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৭.৪২% এবং গড় মূল্যস্ফীতি ৬.২%। আমরা চেষ্টা করছি অর্থনীতির চাকা সচল রাখে দ্রব্যমূল্যের দাম সহনীয় রাখতে ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনা মহামারীতে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বের সব দেশেই দ্রব্যমূল্য ভীষণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে অনাকাঙ্খিতভাবে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর কুফল হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে জনবান্ধব বর্তমান সরকার দেশের নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সম্ভাব্য সব রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকারপ্রধান এসময় নিত্যপণের মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। তিনি জানান, টিসিবির বিক্রয় কার্যক্রম চলমান থাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার মূল্য উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
তিনি বলেন, ঈদুল আজহা উপলক্ষে চলতি মাসের ২২ জুন থেকে সারাদেশে টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডধারী এক কোটি পরিবারের মাঝে ২ লিটার সয়াবিন তেল, ১ কেজি চিনি, ২ কেজি মশুর ডাল সাশ্রয়ী মূল্যে বিক্রি শুরু হয়েছে। ফলে নিম্ন আয়ের মানুষ উপকৃত হবে। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল থাকবে এবং কোনও পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করার সুযোগ থাকবে না। এ ছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণের লক্ষে জরুরি পরিস্থিতিতে প্রয়োজনে প্রতি মাসে টিসিবি থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে পেঁয়াজসহ অন্যান্য পণ্য টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডধারী ১ কোটি পরিবারের মাঝে বিক্রয় করা হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ঢাকাসহ সকল মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বাজার মনিটরিং ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে। এই অধিদপ্তর প্রত্যেক মাসে সারাদেশে ৩০০-এর অধিক বাজার পরিদর্শনমূলক অভিযান পরিচালনা করছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখাসহ ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন বাজারে মূল্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার লক্ষে ৪২টি বাজার মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে প্রতিদিন ৪টি করে সপ্তাহে মোট ২৮টি টিম ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন বাজারে মূল্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।