উত্তরায় বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি প্রকল্পের বক্স গার্ডার দুর্ঘটনায় ঠিকাদারি কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে আপত্তি করবে না চীন। গার্ডার দুর্ঘটনায় ঠিকাদারি কোম্পানির দায় খুঁজে পেয়েছে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি।
এই দুর্ঘটনার জন্য মন্ত্রণালয়ের তদন্তে চীনা ঠিকাদারি কোম্পানির দায়ের বিষয়টি উঠে আসার পর ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এ কথা জানান।
বৃহস্পতিবার সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে তিনি এ কথা বলেন বলে মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
সচিবালয়ে বৃহস্পতিবার সকালে চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং গত ১৫ আগস্ট উত্তরায় ঢাকা বিআরটি প্রকল্পের গার্ডার দুর্ঘটনায় প্রাণহানিতে গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং নিহতদের পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানান। তিনি আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন।
এ সময়ে চীনের রাষ্ট্রদূত গার্ডার দুর্ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো আপত্তি থাকবে না বলে জানান।
গাজীপুর থেকে ঢাকার বিমানবন্দর মোড় পর্যন্ত বিরতিহীন বাস রুট চালু করতে বিআরটি প্রকল্পের এই কাজটি শুরু হয়েছে ২০১২ সালে। শেষ করার কথা ২০১৭ সালে। তবে নানা জটিলতায় বারবার পিছিয়েছে কাজ। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এই কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
প্রকল্পটি চীনের জিয়াংশু প্রভিন্সিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড ও গেজুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড বাস্তবায়ন করছে।
দুর্ঘটনার পরপরই ঠিকাদারি কোম্পানির অবহেলার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি না করে ক্রেন দিয়ে ৭০ টন ওজনের বক্স গার্ডারটি তোলা হচ্ছিল। সেটি একটি গাড়িতে তোলার সময় প্রাইভেট কারকে চাপা দেয়। এতে নিহত হয় পাঁচজন।
ঠিকাদারি কোম্পানির অবহেলার আরও নমুনার কথা জানিয়েছে র্যাব। যিনি ক্রেনটি অপারেট করছিলেন, তিনি এর চালক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত নন। তার সহকারী সেটি অপারেট করছিলেন।
বিআরটি প্রকল্পের থার্ড পার্টি হিসেবে বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেড থেকে মাসিক ভাড়ার চুক্তিতে ক্রেনটি আনা হয়। ক্রেনটি ১৯৯৬-৯৭ সাল থেকে চলছে। প্রথমে ক্রেনটির সক্ষমতা ৮০ টন ছিল। পরে ধীরে ধীরে ক্রেনটির সক্ষমতা কমে যায়। সর্বশেষ ক্রেনটি দিয়ে ৪৫ থেকে ৫০ টন ভর শিফট করা সহজ ছিল। কিন্তু এই ক্রেন দিয়ে ৬০ থেকে ৭০ টন ওজনের গার্ডারটি শিফট করা হচ্ছিল।
আবার যে চালককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তার ভারী গাড়ি চালানোর অনুমোদন নেই। তার লাইসেন্স হালকা যানের।
এত ভারী গার্ডার উঠানোর সময় ক্রেনে কাউন্টার ওয়েট রাখার দরকার ছিল। তাও রাখেনি দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা। ফলে ক্রেনের বাড়তি ওজন বহন করা সম্ভব হয়নি।
বিআরটি প্রকল্পের অবহেলায় এর আগেও ঝরেছে প্রাণ। কিন্তু ঠিকাদারি কোম্পানি এর পরেও পর্যাপ্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়নি।
গত ১৫ জুলাই গাজীপুরে একই প্রকল্পের ‘লঞ্চিং গার্ডার’ চাপায় এক নিরাপত্তারক্ষী নিহত হন। এ দুর্ঘটনায় এক শ্রমিক ও একজন পথচারী আহত হন।
চীনা রাষ্ট্রদূত সড়ক সচিবকে জানান, এই দুর্ঘটনার তদন্তে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল তার দেশ থেকে বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে। প্রতিনিধিদলটি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটিকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেবে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব বলেন, ‘এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় সমগ্র জাতি ব্যথিত।’ যেকোনো উন্নয়নকাজে নিরাপত্তার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটিতে আমরা বুয়েটের একজন বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্ত করেছি।’ আগামী সাত দিনের মধ্যে কমিটিকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, ‘প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
মন্ত্রণালয়ের তদন্তে দায় ঠিকাদারি কোম্পানির
দুর্ঘটনার পর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় যে তদন্ত কমিটি করে, তারা ঠিকাদারি কোম্পানিকে দায় দিয়েছে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী এই তথ্য নিশ্চিত করে বলেছেন, ‘ছুটির দিনে ঠিকাদারের কাজ করার কথা না। তারা কোনো রকম নিরাপত্তাব্যবস্থা না নিয়েই কাজ করছিল। এভাবে উন্মুক্ত রেখে কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। নিয়মানুযায়ী কাজ করতে হলে আগের দিন তারা একটি ওয়ার্ক প্ল্যান দেবে, তাদের কতজন লোক থাকবে, কতগুলো ক্রেন লাগানো হবে, কখন পুলিশকে জানাবে- এসব থাকে।’ ‘ঠিকাদার এগুলো না করেই কাজটি করেছে। কোনো অবস্থাতেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা না করে এ ধরনের কাজ করার কোনো সুযোগ নেই।’