প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাঙালি জাতির ভাগ্য নিয়ে আর কেউ যেন ছিনিমিনি খেলতে না পারে সেজন্য দেশবাসীর প্রতি তাঁর আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘বাঙালি জাতিকে আমি আহ্বান জানাই- জাতির ভাগ্য নিয়ে কেউ যেন ছিনিমিনি খেলতে না পারে।’প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই দেশ আমাদের, আমরা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি। কাজেই জাতির পিতার আদর্শ নিয়ে বিশ্বে এগিয়ে যাবে এবং বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।২০৪১ সাল নাগাদ স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাঁর অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, স্মার্ট জনগোষ্ঠী,স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভমেন্ট, স্মার্ট সোসাইটি-এই আমরা গড়ে তুলবো। এটাই আমাদের লক্ষ্য।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজংয়ের মাওয়া রেলওয়ে স্টেশনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ঢাকা-ভাঙ্গা অংশের উদ্বোধনকালে দেওয়া প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে শেখ রেহানা উপস্থিত ছিলেন।প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে যারা ভোটের কথা বলে, অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলে-আওয়ামী লীগ সরকারে আছে বলেই এদেশে অবাদ নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। আর যারা নির্বাচনের ধোঁয়া তুলে আমাদের প্রতিদিন ক্ষমতা থেকে হটায় তারা কখনো অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় না। কারণ তাদের প্রতিষ্ঠাই হয়েছে একজন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীর হাত দিয়ে এবং ভোট চুরি করা ছাড়া কোনদিন ক্ষমতায় আসে নাই। যে কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামাত নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ৩ শ’ আসনে মাত্র ২৯টি আসন পেয়েছিল বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, তারপর থেকে তারা নির্বিাচন বয়কট আর নির্বাচন নিয়ে খেলা, অগ্নিসন্ত্রাস, মানুষ হত্যা, মানুষের জীবন নিয়ে খেলা- এই ধ্বংসযজ্ঞেই মেতে আছে।জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণের সেই অমোঘ মন্ত্র ‘বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’ স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, বিদেশি অর্থায়ন বন্ধের পর আমরা নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণের যে ঘোষণা দিয়েছিলাম, আজকে তা করে দেখিয়েছি। আবারও প্রমাণ করেছি বাঙালি ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ তাকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না।পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের প্রসঙ্গ টেনে ড. ইউনূসের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, সামান্য একটি ব্যাংকের এমডি পদে থাকতে পারবে না বয়সের কারণে, সেটা বলার জন্য বিশ্ব ব্যাংক তারপক্ষে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিল। এরপরই আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করবো।‘পদ্মা নদী রেলে করে পাড়ি দেয়া, আজকে দিনকে সেই স্বপ্ন পূরণের দিন’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি চলমান বিশ্ব মন্দা প্রেক্ষাপটে দেশের সকল অনাবাদি জমিকে চাষের আওতায় আনার মাধ্যমে সার্বিক উৎপাদন বাড়ানোয় তাঁর আহ্বানেরও পুনরোল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, কারো কাছে হাত পেতে বা মাথা নিচু করে নয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের বাংলাদেশে প্রতিটি মানুষ বিশ্ব দরবারে সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে চলবে এটাই আমাদের লক্ষ্য।রেলপথ মন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য (মুন্সিগঞ্জ-২) সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বক্তৃতা করেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর স্বাগত বক্তৃতা করেন।অনুষ্ঠানে ঢাকা ও যশোরের মধ্যে রেল যোগাযোগের ওপর একটি ভিডিও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।এ সময় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান ও প্রকল্প পরিচালক আফজাল হোসেন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে একটি মানুষও ভূমিহীন ও গৃহহীন থাকবে না। এলক্ষ্যে তাঁর সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে এবং ইতোমধ্যে ৮ লাখ ৪০ হাজার ভূমিহীন ও গৃহহীনকে ভূমি ও গৃহ দিয়েছে। সব জেলা উপজেলায় মডেল মসজিদ করে দিয়েছে ।তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য দেশকে আরও উন্নত করা। ছাত্র ছাত্রীদের বিনামূল্যে বই দিচ্ছি। আড়াই কোটি শিক্ষার্থী বৃত্তি-উপবৃত্তি পাচ্ছে। যাতে দেশটা এগিয়ে যায়। ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি, এখন আমাদের লক্ষ্য, স্মার্ট বাংলাদেশ। প্রতিটি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দিয়েছি। ল্যাব করে দিয়ে কম্পিউটার শিক্ষা দিচ্ছি। লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং কর্মসূচির মাধ্যমে ৬ লক্ষ্য ফ্রিল্যান্সারকে প্রশিক্ষিত করেছি। ব্রডব্যান্ড সুবিধা প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেয়ায় তারা বিভিন্ন ইউনিয়নে ঘরে বসে দেশ বিদেশের কাজ করে অর্থ উপার্জন করছে।
শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন, ‘দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। দায়িত্ব গ্রহণের পর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয় এবং বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেলপথ সংযোগের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করি। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় এসে রেল সঙ্কোচন শুরু করে। বন্ধ হয়ে যায় বহু রেল লাইন। ২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে আমরা রেলওয়ে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ব্যাপক পরিকল্পনা এবং কার্যক্রম গ্রহণ করি এবং ২০১১ সালে স্বতন্ত্র রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠন করি।
তিনি বলেন, গত প্রায় ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার ৮৭৩ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণ করেছে। ২৮০ কিলোমিটার মিটারগেজ রেলপথকে ডুয়ালগেজে রূপান্তর করা হয়েছে এবং ১ হাজার ৩৯১ কিলোমিটার লাইন পুনর্বাসন/পুনঃনির্মাণ করা হয়। এই সময়ে আমরা ১ হাজার ৩৭টি নতুন রেলসেতু নির্মাণ ও ৭৯৪টি রেলসেতু পুনর্বাসন/পুনঃনির্মাণ করেছি এবং ১৪৬টি নতুন স্টেশন ভবন নির্মাণ ও ২৩৭টি স্টেশন ভবন পুনঃনির্মাণ করি।দেশের রেল যোগাযোগ উন্নয়নে তাঁর সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, রেলের সার্বিক উন্নয়নে ইতোমধ্যে ১১১টি লোকোমোটিভ, ৬৫৮টি যাত্রীবাহী ক্যারেজ, ৫১৬টি মালবাহী ওয়াগন, ৫০টি লাগেজ ভ্যান বাংলাদেশ রেলওয়েতে সংযুক্ত হয়েছে। বিভিন্ন রুটে মোট ১৪৩টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। ১৩৪টি স্টেশনে সিগন্যালিং ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন করা হয়েছে।তিনি বলেন, তাঁর সরকার অভ্যন্তরীন এবং আঞ্চলিক রেল যোগাযোগ বৃদ্ধির বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে এবং ডুয়েল গেজ এবং ব্রডগেজ দু’ধরনের রেল নেটওয়ার্কই নির্মাণ করে দিচ্ছে। যাতে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের রেল আরো সক্ষমতা অর্জন করে।প্রধানমন্ত্রী বলেন, আরও ৪৬টি নতুন ব্রডগেজ লোকোমোটিভ, ৪৬০টি নতুন ব্রডগেজ যাত্রীবাহী ক্যারেজ, ২০০টি নতুন মিটারগেজ যাত্রীবাহী ক্যারেজ, ১ হাজার ৩১০টি নতুন ওয়াগন সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা আশাকরি আগামী ৩ থেকে ৪ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে রেলওয়ে যোগাযোগ আরো ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে এবং মানুষের জীবনমান আরো উন্নত হবে।শেখ হাসিনা বলেন, আজকের এই প্রকল্পটি যেটা ভাঙ্গা পর্যন্ত এখন করেছি সেটা ভাঙ্গা থেকে যশোরে সংযোগ হবে। আর যশোর থেকে মোংলা পোর্ট পর্যন্ত সংযুক্ত হবে। এমনকি বরিশাল, পটুয়াখালি থেকে পায়রা পর্যন্ত এই রেললইনকে যুক্ত করার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। যদিও সেখানে মাটি নরম থাকায় কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তবে এ ব্যাপারে সাম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা চরছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।তিনি ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে বাংলাদেশকে সংযুক্ত করাই তাঁর সরকারের লক্ষ্য বলেও উল্লেখ করেন।স্মার্ট বাংলাদেশে সবকিছু যাতে স্মার্ট হয় তা নিশ্চিত করাই তাঁর সরকারের লক্ষ্য উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, এই প্রকল্পে রেললাইন ছাড়াও নির্মাণ করা হয়েছে সুপরিসর ওয়েটিং রুম, নারী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক টয়লেট, যাত্রীদের উঠানামার সুবিধার্থে লিফ্ট, এক্সিলেটর, বেবি কেয়ার কর্নারসহ আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ১৪টি নতুন স্টেশন। মানোন্নয়ন করা হচ্ছে ৬টি রেলওয়ে স্টেশনের। ইতোমধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে ৬০টি মেজর ব্রীজ, ১৪৪টি কালভার্ট, ১২৮টি আন্ডারপাস। ২০টি স্টেশনে স্থাপন করা হচ্ছে আধুনিক কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সিগনালিং ব্যবস্থা। ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গাতে নির্মাণ করা হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন ও সুবিশাল ওভারহেড স্টেশন। ঢাকা হতে যশোর পর্যন্ত স্টেশন এলাকায় ও রেল লাইনের দু’পাশে রোপন করা হচ্ছে ১০ লক্ষাধিক ফলদ, বনজ ও ওষুধি প্রজাতির গাছ।
তিনি বলেন, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৯টি জেলা – ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নড়াইল ও যশোরকে সংযুক্ত করবে। ১ম ধাপে ঢাকা হতে ভাঙ্গা অংশ সমাপ্তির মধ্য দিয়ে নতুন ৩টি জেলা- মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় এলো।